ইদানিং কালের ফেসবুকের বিজনেস পেজ বা গ্রুপগুলোতে আলোচনার অন্যতম হট টপিক “আপনার বিজনেসের জন্য কেন ওয়েবসাইট থাকা জরুরী।” এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বেশিরভাগই যে যুক্তি দেন সেটা হলো যারা এফকমার্স করে মানে শুধুমাত্র ফেসবুক পেজ বা গ্রুপের মাধ্যমে যারা বিজনেস করে, কোনো কারনে যদি বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক বন্ধ ঘোষণা করে বা ফেসবুকই যদি তার পেজকে বন্ধ করে দেয় তাহলে তার পুরো বিজনেস এখানেই শেষ। তার নিজের কোনো কন্ট্রোল নাই এখানে। অন্যের জমিতে সাময়িক সময়ের জন্য চাষবাস করে খাওয়া আরকি। যেদিন মালিক তাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করে দিবে সেদিন সে পথের ফকির, কিচ্ছু করার নাই। “গণি মিয়ার নিজের কোনো জমি নাই, সে অন্যের জমিতে ফসল ফলায়।”
আর কিছু মানুষ হয়তো যুক্তি দেয় যে, ওয়েবসাইট থাকলে আপনার কাস্টমাররা দিনরাত ২৪ ঘন্টাই আপনাকে খুঁজে পাবে। যখন খুশি তখন অর্ডার করতে পারবে। সব প্রোডাক্ট সাজানো গোছানো অবস্থায় ওয়েবসাইটে খুঁজে পাবে। প্রাইস, কালার, সাইজ, অন্য যেকোনো স্পেসিফিকেশন জানতে পারবে কোনপ্রকার হয়রানি ছাড়াই। এজন্য আপনার মেসেজের রিপ্লাইয়ের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে না। আপনাকেও আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হবে না মেসেজিং এর পিছনে।
এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে, কোনো ভুল নাই। উপরের সবগুলো কারণই ভ্যালিড। কিন্তু তারপরও আমার মনে হয় এক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট সবাই মিস করে যায়। কেউই আলোচনা করে না। তা হলো ওয়েবসাইট থাকলে কাস্টমারের each & every data আপনি ট্র্যাক করতে পারবেন। অবশ্য বুষ্টিং নির্ভর বাংলাদেশে হয়তো এতটা আশা করাও বোকামি। সবাই শুধু শর্টকাট খুঁজে।
এখানে each & every data বলতে আবার কাস্টমারের পার্সোনাল ডেটাকে বুঝায় না। এমন না যে কাস্টমারের নাম, ঠিকানা, বয়স আপনি পেয়ে যাবেন। তাই ভয়ের কোনো কারন নাই। কাস্টমারের ডেটা বলতে এখানে কাস্টমার আপনার ওয়েবসাইটে প্রবেশের পর কেমন বিহেভিয়ার করছে, কোন কোন পেইজ ভিজিট করছে, কত সময় ধরে ভিজিট করছে, কাস্টমার টেম্পেরাচার কেমন (কোল্ড, ওয়ার্ম, হট) ইত্যাদি বুঝায়।
ধরুন, আপনি একটি ফেসবুকে অ্যাড ক্যাম্পেইন রান করলেন, সেই ক্যাম্পেইনে একটি লিংকের মাধ্যমে আপনি আপনার কাস্টমারদেরকে ওয়েবসাইটের একটি নির্দিষ্ট ল্যান্ডিং পেইজে ল্যান্ড করালেন। পেইজে ল্যান্ড করার পর কাস্টমার ২টা কাজ করতে পারে। হয় তিনি ল্যান্ডিং পেইজ ঘুরেই চলে যেতে পারেন অন্য কোনো পেইজ ভিজিট না করেই। অথবা ল্যান্ডিং পেইজ দেখে আকৃষ্ট হয়ে ওয়েবসাইটের অন্যান্য পেইজেও তিনি ভিজিট করতে পারেন।
ধরলাম, কাস্টমার ল্যান্ডিং পেইজ দেখে আকৃষ্ট হয়ে আরো কিছু রিলিভেন্ট পেইজ ভিজিট করলো। সম্ভাব্য কাস্টমার জার্নিটা নিচে দেখানো হলোঃ
ল্যান্ডিং পেইজ> প্রোডাক্ট পেইজ-১> প্রোডাক্ট পেইজ-২……...৫> অ্যাড টু কার্ট> ভিউ কার্ট> প্রোসিড টু চেক আউট> বিলিং ডিটেইলস> প্লেস অর্ডার ।
এখন কিছু মানুষ ল্যান্ডিং পেইজ থেকে প্রোডাক্ট পেইজ পর্যন্ত যাবে, কিছু মানুষ ১টা প্রোডাক্ট পেইজ ভিজিট করবে, কিছু মানুষ ২টা, কিছু মানুষ ৩/৪/৫…...। এখন যে মানুষ ১টা প্রোডাক্ট পেইজ ভিজিট করবে তার তুলনায় যে ২টা /৩টা পেইজ ভিজিট করবে তিনি বেশি পটেনশিয়াল, তাইনা? এভাবে যে কাস্টমার ৪/৫ বা আরো বেশি প্রোডাক্ট পেইজ ভিজিট করবে তিনি ২/৩টা পেইজ ভিজিট করা মানুষের তুলনায় আরো বেশি পটেনশিয়াল?
এভাবে যে কাস্টমার শুধু প্রোডাক্ট পেইজ ভিজিট করবে তার তুলনায় যিনি অ্যাড টু কার্ট করবে তিনি বেশি পটেনশিয়াল? কারন তিনি আরো একধাপ বেশি এগিয়েছেন। যিনি ভিউ কার্ট করেছেন তিনি অ্যাড টু কার্ট করা মানুষের তুলনায় বেশি পটেনশিয়াল? আবার যিনি প্রোসিড টু চেক আউট করেছেন তিনি ভিউ কার্টের তুলনায় বেশি পটেনশিয়াল? যিনি বিলিং ডিটেইলস দিয়ে প্লেস অর্ডার করেছেন তিনি সবার চাইতে বেশি পটেনশিয়াল। এককথায় বলতে গেলে তিনি অলরেডি কনভার্সন করেই ফেলেছেন।
এতোকিছু বলার কারন আপনাদেরকে কাস্টমার জার্নিটা বুঝানো আর কাস্টমার টেম্পেরাচার সম্পর্কে আইডিয়া দেওয়া। গুরুত্বটা বুঝানো।
এখন আসল খেলা শুরু।
আপনি কি জানেন এতোক্ষণ কাস্টমারের যেসব প্যাচাল পারলাম সে-সওওওব কিছু আপনি ট্র্যাক করতে পারেন খুব সহজেই?
অর্থাৎ, একজন কাস্টমার আপনার ওয়েবসাইটে আসার পর কত সময় থাকলো, কোন কোন পেইজ ভিজিট করলো, কোন পেইজ কত পার্সেন্ট স্ক্রল করলো, কোনো ফাইল ডাউনলোড করলো কিনা, ওয়েবসাইটে কোনো ভিডিও থাকলে তা ওপেন করলো কিনা, করলে কত পার্সেন্ট ভিউ করলো, ভিডিওর প্লে,পস অথবা স্টপ বাটনে ক্লিক করলো কিনা, ওয়েবসাইটের কোনো ইমেজের উপর ক্লিক করলো কিনা, অ্যাড টু কার্ট-ভিউ কার্ট-প্রোসিড টু চেক আউট-প্লেস অর্ডার-সাবস্ক্রিপশন-সাবমিট বাটনে ক্লিক করলো কিনা, কোনো আউটবাউন্ড লিংক এ ক্লিক করলো কিনা, ওয়েবসাইটে থাকা ফোন নাম্বার-ইমেইল অ্যাড্রেসে ক্লিক করলো কিনা এসবকিছু ট্র্যাক করা যায় খুব সহজেই।
শুধু তাইনা কাস্টমারের লোকেশন, ডেমোগ্রাফি, ইন্টারেস্ট, ডিভাইস, কোন কোন পথ পাড়ি দিয়ে মানে কোন ডিভাইস/ মিডিয়াম ব্যবহার করে এসে আপনার প্রোডাক্ট কিনেছে ইত্যাদি ছাড়াও আরো অনেককিছু ইনডিটেইলস ট্র্যাক করা যায়, যা আপনার ধারণারও বাইরে।
এখন প্রশ্ন করতে পারেন, এতোকিছু ট্র্যাক করে কি হবে? কাস্টমারের এতো ইনফরমেশন দিয়ে কি করবো?
এই প্রশ্ন আপনার মাথায় আসার কথা না। আর যদি ভুল্ক্রমে আসেও তাহলে বলার কিছুই নাই। আপনি ব্যবসা করবেন অথচ আপনার কাস্টমার বিহেভিয়ার বোঝার গুরুত্বটা আপনি এখনো বুঝতে পারছেন না? কাস্টমার কি করে, কোথায় থাকে, ইন্টারেস্ট কি, আপনার ওয়েবসাইটের গিয়ে সে কি করে এসব কিছু জানার কোনোই প্রয়োজন নাই? কি বলেন আপনি এসব?
বিশ্বখ্যাত ম্যানেজমেন্ট গুরু পিটার ড্রাকার একটি কথা বলেছেন, “If you can’t measure it, you can’t improve it.”
আসলেও তাই। আপনি ব্যবসায় উন্নতি করতে চান অথচ আপনার কাছে কাস্টমারের ডেটা নাই, স্ট্যাটিস্টিক্স নাই এটা একপ্রকার গাঁজাখুরি কথাই বলা চলে।
পরিশেষে দুই-একটা স্ট্যাটিস্টিক্স বলে যাই যাতে করে আপনার মনে কিছুটা হলেও চিন্তার উদ্রেক হয়।
১। ইকমার্স জগতে এভারেজ কার্ট এবান্ডনমেন্ট রেট ৬৯.৫৭%। মানে এতো মানুষ প্রোডাক্ট কার্টে অ্যাড করার পরও না কিনেই চলে যায়।
২। মোবাইল ইউজারদের মধ্যে এর চাইতেও বেশি এবান্ডনমেন্ট রেট দেখা যায় যা ৮৫.৬৫%।
৩। ইকমার্স ব্যান্ডগুলো প্রতিবছর ১৮ বিলিয়ন ডলার রেভিনিউ লস করে এই উচ্চ এবান্ডনমেন্ট রেটের কারনে। ( https://tinyurl.com/5474eknh )
৪। ২৫% অনলাইন ভিউয়ার রিটার্গেটেড অ্যাড দেখতে পছন্দ করে।
৫। যেসব ওয়েবসাইট ভিজিটরদেরকে রিটার্গেটেড অ্যাড দেখানো হয় তাদের কনভার্ট হওয়ার হার ৪৩%।
৬। ই-মার্কেটারের তথ্যমতে, প্রতি ৫ জন ভিজিটরের মধ্যে ৩ জন ভিজিটর রিটার্গেটিং অ্যাডসকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে যেসব প্রোডাক্টের অ্যাড তারা ইতোমধ্যে অন্য কোথাও দেখেছে।
৭। যেকোনো সচরাচর ডিসপ্লে অ্যাডের চাইতে রিটার্গেটিং অ্যাডের CTR ১০ গুণ বেশি হয়।
( https://tinyurl.com/4sh3z6uv )
৮। যেখানে সাধারন অ্যাড থেকে কনভার্সন রেট আসে সর্বোচ্চ ১-২%, সেখানে রিটার্গেটিং অ্যাড এর কনভার্সন রেট ৫-৭% পর্যন্ত হয়ে থাকে।
কি বুঝলেন?
-কিছুই না!
ওকে। বুঝিয়ে বলছি। এই যে এতো মানুষ কার্টে প্রোডাক্ট অ্যাড করছে তারা কিন্তু আপনার প্রোডাক্ট সম্পর্কে ইন্টারেস্টেড বলেই কার্টে অ্যাড করছে। কিন্তু বিভিন্ন কারনে তারা এবান্ডন করছে। সেটা হতে পারে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব, ট্যাকনিক্যাল ইরোর, পরে কিনবে বলে কার্টে অ্যাড করে রাখে কিন্তু পরে ভুলে যায়, পেমেন্ট করার মতো অবস্থায় থাকে না ইত্যাদি। এখন এসব হাইলি ইন্টাররেস্টেড মানুষকে যদি আপনি রিটার্গেটিং করে বারবার প্রোডাক্টের অ্যাড দেখাতে থাকেন সম্ভাবনা খুবই বেড়ে যায় যে তারা আপনার প্রোডাক্ট কিনবে। এক্ষেত্রে কনভার্সন রেট খুবই হাই হয়। রিটার্গেটিং এর ফলে হয় কি একই জিনিস বারবার দেখতে দেখতে প্রোডাক্টের কথা কাস্টমারের মনে গেঁথে যায় ভালোভাবে, তাদের স্মরণ পড়ে যে প্রোডাক্ট কার্টে অ্যাড করেছিলো, প্রোডাক্টটি তাদের প্রয়োজন, বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে।
আর এতসব কিছু করার জন্য আপনার কাস্টমারের ডেটা ট্র্যাক করা প্রয়োজন। আপনার কাছে যদি ডেটাই না থাকে তাহলে আপনি জানবেন কি করে যে আপনার ওয়েবসাইটে আসার পর কে কি করলো?
আপনি যখন সাধারণ বুষ্টিং মারেন তখন যদু-মধু-কদু সবার কাছেই অ্যাড যায়। কিন্তু তা না করে আপনি যদি ডেটা-ড্রিভেন ওয়েতে অ্যাডভার্টাইজিং করেন, সঠিক কাস্টমার ইনসাইট ইউজ করেন তাহলে শুধুমাত্র আপনার প্রোডাক্টের প্রতি ইন্টারেস্টেড এমনসব মানুষের কাছেই আপনার অ্যাড পৌঁছে যাবে। প্রাথমিক ফিল্টার করে হাইলি ইন্টারেস্টেড অডিয়েন্সের প্রতি রিটার্গেটিং অ্যাড চালালে তো কথাই নাই। কনভার্সন রেট বেড়ে যাবে হু হু করে।
এই ডেটাড্রিভেন মার্কেটিং এর আরেকটা বড় অ্যাডভান্টেজ হচ্ছে আপনি আপনার অডিয়েন্সকে বিভিন্ন সেগমেন্টে ভাগ করে বিভিন্ন ধরনের কাস্টম অডিয়েন্স তৈরি করতে পারেন এবং তা থেকে পরবর্তীতে লুকএলাইক অডিয়েন্স তৈরি করতে পারেন । (লুকএলাইক অডিয়েন্স বলতে বোঝায় ধরেন আপনার ওয়েবসাইটে যেসব অডিয়েন্স অ্যাড টু কার্ট করেছে তাদের মতো বৈশিষ্ট্য় সম্পন্ন আরো যেসব অডিয়েন্স আছে তারা)।
এখনো কি আপনি যথেষ্ট ইম্প্রেসড না কাস্টমার ডেটা ট্র্যাক করার প্রতি?
0 Comments: